সুব্রত মুখার্জী
গোলাপীর ভালোবাসায় সুব্রতগোলাপী।

জীবনের অর্থ শূন্য বলে মনে হয় যখন জীবদ্দশায় সেই জীবনের কীর্তি সমগ্র অবহেলিত ও অগ্রাহ্য হতে থাকে। যে বিশেষ ভঙ্গিমায় মানব মনের কথা স্পষ্ট রূপে উচ্চারিত হওয়া উচিত, তার যে কোনো প্রকার উপলব্ধির আত্ম প্রকাশ ও বৈচিত্র্য যে ভাবে ঘোষিত হওয়া কাম্য তার অন্যথা হলেই জীবনের অর্থ শূন্য বলে মনে হয়। শুধু মাত্র জীবন ধারণের মধ্যেই আমাদের মনের তৃপ্তি সম্পূর্ণ হয় না, শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের সাধনা আমাদের জীবন কে পরিপূর্ণতা দান করে। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জিত হলে জীবন যেন প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠে। সফলতা কী ভাবে, কেমন করে আসবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা হয়না। অনেক প্রচেষ্টার পরেও সফলতা অধরা থাকে আবার কখনও সামান্য প্রচেষ্টাতেই সফল হওয়া যায়। শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিষয় টি এত সহজ নয়।
শ্রেষ্ঠত্ব সর্বদাই মহান। আমাদের জীবনে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন নিঃসন্দেহে ঈশ্বরের করুণা ছাড়া সম্ভব নয়।বহু পরিশ্রম, বহু প্রতিভা অজানা, অদৃশ্য কারণে সাফল্য লাভ করতে পারেনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন তো অনেক দূরের কথা। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, সকল সফল চরিত্র আবশ্যিক রূপে শ্রেষ্ঠ রূপে পরিগণিত হয়নি। আবার অতি আশ্চর্যের বিষয় অনেক শ্রেষ্ঠ জীবনও আমাদের সমাজ সফল রূপে বিবেচিত হতে পারেনি।
জ্ঞানের তপস্যা শারীরিক ও মানসিক অবস্থা গুনে বিভিন্ন স্তরে প্রকাশিত ও উন্নীত হয়। আমি জ্ঞান পিপাসু কিন্তু অভাব গ্রস্ত কিম্বা আমি ধনী কিন্তু জ্ঞানের প্রতি মনোযোগী নই এই দুই অবস্থাতেই কিছু না কিছু সফলতা আসতে পারে কিন্তু শ্রেষ্ঠ রূপে পরিগণিত হওয়া কোন ক্ষেত্রে সম্ভব তা অবশ্যই ভাবনার বিষয়।
যুগাবতার ভগবান শ্রী কৃষ্ণের কথায় “রাজবিদ্যা রাজগুহ্যম পবিত্রম ইদম উত্তমম। প্রত্যক্ষ ভাব গমম ধর্ম্যাং সু সুখম কর্তুম অভ্যয়াম।।” অর্থাৎ জ্ঞান রাজ বিদ্যা স্বরূপ, এবং রহস্য পরিবৃত গোপনীয় তম কিন্তু এই জ্ঞান আত্ম বোধ কে ধর্ম পথে প্রত্যক্ষ রূপে পরিচালিত করে তাকে চির সুখে সুখী করে তোলে। এই বোধই হলো শ্রেষ্ঠত্ব।
The New World (Natun Prithibi)
জীবনের পরিপূর্ণতা সফলতার মধ্যে না শ্রেষ্ঠত্বের মধ্যে এই ভাবনা যে কোনো সংবেদনশীল জ্ঞান অনুরাগী মানুষ প্রতিটি সময়ে করতে থাকবে। আমার প্রয়োজন মিটলে আমি খুশি, আর একটু বেশি পেলে আমি সুখী আরও বেশি পেলে আমি রাজা আর এর কোনোটাই না হলে আমি দুঃখী বিষন্ন ও ব্যর্থ। এই আবর্তনে সাধারণ যে কোনো মানুষের জীবন পরিচালিত হয়ে থাকে।
এই রকম সাধারণ জীবন কিছু পরিমাণে কিছু দিন নিজেকে সন্তুষ্ট করতে পারে কিন্তু যত দিন অতিক্রান্ত হতে থাকে আত্ম সন্তুষ্টি যেন গুরুত্ত হীন হতে থাকে। কোনো এক অজানা, অদৃশ্য শক্তি যেন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে থাকে, আমাকে প্রতিনিয়ত যেন ধাক্কা দিতে থাকে, আমার বিবেক, আমার বুদ্ধি, আমার চিন্তা, আমার মন কে এক অসাধারণ উপলব্ধির পথে আলোকিত করে। আমি সেই চমৎকার আলোর পথে এগিয়ে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠি এবং আমার মস্তিষ্কে, মননে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক অদম্য ইচ্ছা আমাকে শুধু সামনের দিকে প্রকৃত সত্যের পথে টেনে নিয়ে যায়!
মনের নিয়ন্ত্রণ তখনই সম্ভব যখন এই বোধ আসে যে কী গ্রহণ করা উচিত আর কী বর্জন করা প্রয়োজন। কিন্তু বিষয় টি এত সহজ নয়।সাধারণ মানুষের জীবন যাপন সাধারণ এমনকি অতি সাধারণ বিষয় গুলিকে স্পর্শ করে পরিচালিত ও আবর্তিত হয়, তাই মনের নিয়ন্ত্রণ আয়ত্ত করা এত সহজ ভাবে হয়ে ওঠে না। এই নিয়ন্ত্রণ না এলে কখনোই উচিত আর অনুচিত পৃথক হবে না। যা এখন অনুচিত বলে মনে হবে পরক্ষণেই সাধারণ মন তাকেই উচিত বলে গ্রহণ করবে তার ফলে গ্রহণ বর্জন চলতে চলতে জীবন অতিক্রান্ত হয়ে পড়বে। সারা জীবন সুখ আর দুঃখের হিসাবে মগ্ন হয়ে মনের দ্বন্দ্ব চরমে উঠবে শুধু মৃত্যুর মধ্যে সেই দ্বিধা সেই দিশাহীনতার সমাপ্তি ঘটবে।
“অসম্যতাত্মনা ইয়োগা দুস্প্রাপা ইতি মে মতিঃ। ভাস্যাত্মনা তু ইয়াতাতা সাক্য আব্যপ্তুম উপায়তঃ।।” অর্থাৎ যে ব্যক্তি অনুচিত ভোগ বিলাস থেকে নিজের মন কে বিচ্ছিন্ন করতে অক্ষম তার শ্রেষ্ঠত্বের প্রাপ্তি অনিশ্চিত। মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যোগ অভ্যাস সময় নষ্টের প্রতিরূপ ভিন্ন আর কিছুই নয়।
The New World (Natun Prithibi)
এই রকম অবস্থায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন প্রায় অসম্ভব বলা যেতে পারে। যে জীবন শুধু বেঁচে থাকার কারণে সামান্য বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হয়ে ব্যস্ত রয়ে গেল তার কাছে যে কোনো মূল্যে দুঃখের নিবারণ করা অনেক বড় ব্যাপার। যোগ্যতার পরিচয় বহন করে উচিত, অনুচিত ইত্যাদির মানদণ্ডে জীবন কে বিচার না করে শুধু মাত্র ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জনে একাগ্র হয়ে ওঠে তাই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব বলে মনে হয়।
বিচার করলে বিষয় টি আরও ভালোভাবে বোঝা যায়। যে প্রতিভার বিচ্ছুরণ অতীতে দেখেছি, যে আদর্শ, সততা, মূল্যবোধ, ত্যাগ, তিতিক্ষা মানব তথা সমাজ জীবনে স্বাভাবিক অবস্থায় পরিলক্ষিত ও অনুসৃত হতো আজ তার অস্তিত্ব প্রায় বিরল। যে জীবন শুধু বেঁচে থাকার কথা লক্ষ্য বলে গ্রহণ করতো না, সেই সুমহান দূরদৃষ্টি সম্পন্ন সত্বা আজ ভাবনাতেই অসম্ভব।
শুধু মাত্র তাৎক্ষণিক ভালো থাকার লক্ষ্যে চিরকালীন সৃষ্টি ও তার সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে যায়। যে বৃক্ষের ছায়ায় আমার প্রাণ শান্তির খোঁজ পেলো সেই বৃক্ষ আমার বহু আগে কোনো মহাত্মার হাতে রোপিত হয়েছিল। আমি তো শুধু নিজের কারণে বেঁচে থাকার কথা স্মরণ করে সুখী তাই নিজের সুখের বিনিময়ে আমি সব কিছুতেই সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক। তাহলে আমার দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন এক প্রকার অসম্ভব বলা যেতে পারে।
মানব জীবন তো শুধু নিজের সুখের জন্যে নয়। সফলতা অর্জন একান্ত ব্যক্তিগত কিন্তু শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন ব্যক্তি পরিসীমার অনেক বাইরে। আমি, তুমি আজ যে নিজেদের অস্তিত্ব কে বাঁচিয়ে ও সম্মান নিয়ে জীবন ধারণ করছি তার কৃতিত্ব কোনো ব্যক্তির সফলতা মধ্যে নেই, এই কৃতিত্ব সেই মহান জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পরিপূর্ণতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত যে জীবন শুধু নিজের সুখের ইচ্ছা কে কোনোদিনও বিন্দুমাত্র প্রাধান্য না দিয়ে সফলতা কে অতিক্রম করে অনেক বড় তপস্যায় নিজেকে শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে!
The New World (Natun Prithibi)
মূল গ্রন্থ “সফল জীবন, শ্রেষ্ঠ জীবন” থেকে সংগৃহীত।
লেখক সুব্রত মুখার্জী
The New World (Natun Prithibi)
©️ Subratagolapi