উষ্ণতার শীতলতা!

সুব্রত মুখার্জী

গোলাপীর ভালোবাসায়, সুব্রতগোলাপী।

“ঈশ্বর মনুষ্য রূপেই আবির্ভূত হইয়া মনুষ্য জীবন ধারণ করিয়া মনুষ্য প্রাণের দুঃখ কষ্ট কে আপন দুঃখ কষ্টের কারণ করিয়া তুলিয়া সাধারণ মনুষ্য হইতেই ঈশ্বরত্বে উপনীত হইয়াছেন। এই সহজ সত্যটি অনুধাবন করিলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং তাঁহার মহান উপদেশের অনুসরণ মনুষ্য প্রাণের পক্ষে সহজ হইতে পারে।”

নতুন পৃথিবী
The New World (Natun Prithibi)

শৈশব কাল হইতেই দেখিয়া আসিতেছি মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে বৈচিত্র্য যেন এক অতি সাধারণ বিষয়। মনুষ্য জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সেই বৈচিত্র্য দৃষ্টি গোচর হইয়া থাকে। শিশু বয়সে দেখিতাম কিন্তু ভালোকরিয়া বুঝিতে পারিতাম না কিন্তু আমার মধ্যে যত যত বুদ্ধির বৃদ্ধি হইয়াছে ততই যেন আরো স্পষ্ট রূপে বুঝিতে পারিয়াছি মনুষ্য প্রাণের ভিন্ন ভিন্ন বৈচিত্র্যের লীলা।

আজিকার সমাজব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি পাত করিলে এই অতি অসাধারণ বৈচিত্র্য পূর্ণ ঘটনাপ্রবাহের পরিমণ্ডলে ততোধিক বৈচিত্র্য পূর্ণ মনুষ্য প্রজাতির ব্যাপক কর্মকাণ্ডের আভাস অনুধাবন করা অসম্ভব নহে। যাহার অনুভূতি সক্রিয় তাহার পক্ষে এই অতি অসাধারণ পরিবেশের বিবরণ সংগ্রহ করা অতি সহজসাধ্য বলিয়া আমি মনে করি। যাহারা অপেক্ষাকৃত কম অনভূতি প্রবণ তাহাদের কিছুটা সময় ব্যায় হইলেও হইতে পারে তথাপি তাহারও এই বৈচিত্র্যের আস্বাদ হইতে কোনরূপেই বঞ্চিত হইবেনা ।

পাঠক বর্গ আমার উপরে কিঞ্চিৎ ক্ষুন্ন হইতে পারেন কারণ আমি আমার প্রসঙ্গের ভূমিকা সামান্য কিছু পরিমাণে দীর্ঘায়িত করিয়া তুলিতেছি কিন্তু আমি একপ্রকার নিরুপায় হইয়াই এমন দীর্ঘ প্রস্তাবনার সাহায্য লইয়াছি। পাঠক বর্গ অনুভব করিবেন যে বিষয়ের প্রস্তাবনা এত বৃহৎ হইতে পারে তাহা হইলে সেই বিষয়টিও সন্দেহাতীত রূপে অনেক বৃহৎ, বিস্তারিত এবং গুরুত্বপূর্ণ হইবে।

The New World (Natun Prithibi)

ঈশ্বরের সৃষ্ট সকল প্রাণীকুলের মধ্যে সর্বোত্তম ও মহান তম শ্রেণীতে মনুষ্য জীব কে উত্তম আকারের আসনে অতি উচ্চ শ্রদ্ধার পরিমণ্ডলে প্রতিষ্ঠিত করিবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল জ্ঞাত এমনকি অজ্ঞাত প্রাণ সভ্যতার ইতিহাসে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কী প্রকার আশ্চর্য চমৎকার শক্তি বলে মনুষ্য শ্রেণী এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সহস্র অযুত প্রাণের অস্তিত্বের সকল সশব্দ এবং নিঃশব্দ উপস্থিতির মধ্যে সর্বোত্তম প্রাণী রূপে আবির্ভূত হইল তাহা রহস্যাবৃত ও অকল্পনীয় বলিয়া গণ্য হইতে পারে! যদিও এমন অভাবনীয় রহস্য বিজড়িত, অত্যন্ত সূক্ষ্ম, জটিল, পর্বত প্রমাণ সুউচ্চ এবং গভীর অরণ্যের ন্যায় দুষ্প্রবেশ্য বিষয়ের রহস্যোদঘাটন অসমসাহসী ও অত্যুৎসাহী মনের পরিচয় বহন করিয়া থাকে। সেইখানেই বিষয়টি অনুচ্চারিত থাকিয়া আরও অধিকতর অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়া দিনের পর দিন অসম্ভব জটিল আকার ধারণ করিয়াছে। মনুষ্য উচিৎ কর্মে সবিশেষ ব্যস্ত থাকিলে যে পরিমাণে বিষয় নিবদ্ধ হইয়া রহস্যের সমাধানে নিয়োজিত থাকিতে পারে, অবসর মুহূর্ত যাপনের মধ্যে দিয়া তাহা সে পারেনা।

কারণ রূপে বলা যাইতে পারে, সেই খালি কর্মহীন সময়ে মনুষ্য মস্তিষ্ক আরও অনেক বেশী ব্যস্ত হইয়া পড়ে, তখন তাহার পক্ষে কোনো বিষয়েই মনোযোগী হওয়া দুঃসাধ্য। তাহার ফলস্বরূপ, মনুষ্য প্রাণ সামান্য ব্যাতিক্রমী গণনা সাধ্য উদাহরণ ব্যতীত, বহুলাংশে চিন্তা রহিত, সৃষ্টিশুন্য, অতি সাধারণ অভ্যাসের বশবর্তী হইয়া গড্ডলিকা প্রবাহে ভাসমান হইয়া চলিতেছে। জিজ্ঞাসা হীন , প্রশ্নহীন থাকিয়া, আপাত দৃষ্টিতে সর্বজ্ঞানী আচরণ সমৃদ্ধ অথচ প্রকৃত ক্ষেত্রে অন্তঃসারশূন্য হইয়া মনুষ্য প্রাণ অবলীলায় ভাসিয়া চলিতেছে।

এইরূপ শূন্য সার হইয়া ভাসিয়া চলিলে জীবন হয়ত বা থামিয়া যাইবেনা কিন্তু জীবনের অসাধারণ সংক্ল্প গুলি অসম্পূর্ণ রহিবে একথা অনস্বীকার্য। এক্ষণে প্রশ্ন আসিবে, জীবনের সংকল্প বলিতে মনুষ্য কী প্রকার বিবেচনা করিয়া থাকে?এই সংকল্প স্থিরই বা হইবে কী প্রকারে? আর উহা ঠিক করিবার উপায় কী প্রকারে নির্ণয় হইবে?

The New World (Natun Prithibi)

যেক্ষণে এই সমস্ত প্রশ্নাবলী মনুষ্য মনে উপনীত হইবা মাত্র সমাধানের ব্যবস্থা পাইবে, বর্তমান সময়কালের মনুষ্য প্রাণের তথা মনুষ্য সমাজের লক্ষাধিক সমস্যা সংকট গুলিও অতি দ্রত সরলীকৃত হইয়া অনতিবিলম্বে বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। সুতরাং, ইহা প্রতিটি বুদ্ধিমান মনুষ্য মস্তিষ্কে অতি সহজেই প্রবেশ করিবে যে অদ্যাপী মনুষ্য সভ্যতার অন্তর স্থলে যাহা কিছু সমস্যার উপস্থিতি বিন্দুবৎ অবস্থা হইতে ধীরে ধীরে সুপ্ত ও গুপ্ত থাকিয়া ঘূর্ণিত হইয়া কালের প্রবাহে বৃহদাকৃতি ধারণ করিয়াছে তাহার একমাত্র কারণ, মনুষ্য মনের ভিতরে সঠিক সংকল্পের অস্তিত্বহীনতা!

মনুষ্য প্রাণ উদ্দ্যেশ্য হীন জীবন যাপন করিয়া যে প্রকারে অপরিণামদর্শী হইয়া উঠিয়াছে এবং তাহার অভিমুখ যে প্রকারে সৃষ্টির সূক্ষ্ম ও জটিল কর্ম কাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ অবয়ব কে ক্রমাগত অস্বীকার করিয়াছে তাহার ফলস্বরূপ মনুষ্য প্রাণে, জীবনে, সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে কঠিন মারণ ব্যাধি বাসা বাঁধিয়াছে এবং তাহা সঠিক, সময়োপযোগী ও সুচিকিৎসার অভাবে যথেষ্ট জটিল আকার ধারণ করিয়াছে।

যদিও সর্ব প্রকার সমস্যার উদ্ভব হয় সমাধানের নিমিত্ত। সমগ্র পৃথিবীতে এইপ্রকার কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নাই যাহার সমাধান চিরদিনের জন্য অসম্পূর্ণ রহিয়া গিয়াছে! কিন্তু, এই বাক্যটি ও স্মরণ করিতে হইবে, যে সর্ব প্রকার সমস্যার সমাধান তৎক্ষণাৎ সম্ভবপর হইয়া উঠেনা, অনেক ক্ষেত্রেই তাহা সময় সাপেক্ষ বিষয় হইয়া উঠে। মনুষ্য জীবন, সময় নামক মহা উপাদান লইয়া মহান ঈশ্বরের বিচার সভায় ধৈর্য্য ধরিয়া বহুপ্রকার সমস্যা হইতে মুক্তি পাইয়াছে। ঈশ্বরের বিচার মুহূর্তের মধ্যে ঘোষিত হয়না। ঈশ্বরে বিশ্বাসী মনুষ্য জীবন ধৈর্য্য ধরিয়াই ঈশ্বরের বিচারের আশায় বসিয়া থাকে।এই কথা সত্য, যে সময় লাগিলেও ঈশ্বর তাহাদেরকে সঠিক বিচার দিইয়া থাকেন। এই প্রকার বিশ্বাস, ধৈর্য্য ও সময় সাপেক্ষ একাগ্রতা ধারণ করিয়া লক্ষ কোটি মনুষ্য প্রাণের প্রবাহ চলিয়া আসিতেছে।

আপাত দৃষ্টিতে ইহা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী মনুষ্য গণের নিকট অসম্ভব বলিয়া প্রতীয়মান হইলেও অসংখ্য মনুষ্য যাহারা সৎ, নিষ্ঠাবান, চরিত্রবান হইয়াও মনুষ্য সমাজে অবহেলিত, লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত তাহারা শুধুমাত্র সেই মহান ঈশ্বরের কাছেই তাহাদের প্রাণের ব্যাকুল ব্যথা ব্যক্ত করিয়া অসমধৈর্য্য ধরিয়া বিচার প্রার্থনা করিয়া থাকে এবং তাহারা অবশ্য রূপেই তাহাদের অনুরূপ বিচার পাইয়া থাকেন। যদি তাহা না হইত তাহা হইলে সেই প্রকার নিষ্ঠা, সততা, চরিত্র, মানবিক গুণের অধিকারী মনুষ্য প্রাণ সকল এই ধরিত্রী হইতে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইতো!

প্রকৃত পক্ষে সত্যের জয় সর্বদাই সুনিশ্চিত হইয়া আসিতেছে, সাময়িক অবসরে মিথ্যা ও তঞ্চকতা প্রভৃতি সুবিধা পাইলেও পরিশেষে সত্যেরই জয় ঘোষিত হইয়া থাকে। মনুষ্য তাহার দূরদৃষ্টির অভাবে সত্যের পথ হইতে সাময়িক রূপে ভ্রষ্ট হইয়া, বহুবিধ অন্যায় কার্যে নিযুক্ত হইয়া জীবনকে দুঃখের কণ্টক বিদ্ধ বিভীষিকায় ক্লিষ্ট করিয়া তুলে এবং জীবনের অন্তিম লগ্নে কৃত কর্মের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হইতে থাকে। মৃত্যুর পূর্বে হইলেও সে অবশ্যই অনুভব করিয়া থাকে যে, একমাত্র সত্যের পথই চিরস্থায়ী, সুন্দর, ও পবিত্র।

সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা র নিকটে মনুষ্য প্রাণ চিরকৃতজ্ঞ থাকিতে পারে যে, তাহার কৃতকর্মের সমস্ত প্রকার উপলব্ধির ক্ষমতা এইরূপেএকমাত্র মনুষ্যই প্রাপ্ত হইয়াছে। এই চমৎকারী অনুভব ক্ষমতা ঈশ্বর মনুষ্য ব্যতীত অন্য কোনো জীব কেই এত অসামান্য পরিমাণে প্রদান করিয়াছেন কিনা সে প্রশ্নের উত্তর অজ্ঞাত ও অনিশ্চিত। মনুষ্য প্রাণের কল্যাণ কারী ইচ্ছা ও তাহার অনুসারী উচিৎ কর্ম কাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ বহিঃপ্রকাশ মনুষ্য জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘটিয়া থাকিবে ইহাই অভিপ্রেত ও প্রত্যাশিত। মনুষ্য জীবন অন্য অন্য মনুষ্য প্রাণের এবং সমস্ত প্রকার জীবের কল্যাণ করিবে ইহাই তো স্বাভাবিক এবং সৃষ্টি কর্তার নির্দেশ। ইহার পালনের মধ্যে দিয়াই মনুষ্য প্রাণ তাহার এমন সর্বোত্তম অবস্থানের প্রতি সুবিচার করিয়া তাহার গুরুত্ব কে বৈচিত্র্য পূর্ণ এবং মহান করিয়া তুলিবে। ইহাই পরম সত্য, ইহাই পরম ধর্ম।

এমন নির্দেশ পালনের উপযোগী করিয়া ঈশ্বর তাহাকে সর্ব প্রকার গুনে সমৃদ্ধ করিয়াছেন এবং তাহাকে এত প্রকার বৈচিত্র্য ময় করিয়া তুলিয়া এই সুবিশাল ব্রম্ভাণ্ড লোকে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণীর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দিয়াছেন!

উষ্ণতার শীতলতা

The New World (Natun Prithibi)

..নির্বাচিত অংশটি মূল গ্রন্থ, “উষ্ণতার শীতলতা” হইতে গৃহীত।

লেখক সুব্রত মুখার্জী।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s